বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্প এবং ভারতীয় প্রতিযোগিতা: অর্থনৈতিক দুর্বলতা বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের
অর্থনীতির মূল ভিত্তিগুলোর মধ্যে টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস শিল্প অন্যতম।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের এই খাতের জনপ্রিয়তা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে,
ভারতীয় টেক্সটাইল শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা বাংলাদেশি শিল্পপতিদের
জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই প্রতিযোগিতার পেছনে অর্থনৈতিক, প্রযুক্তিগত এবং
নীতিগত অনেক কারণ রয়েছে। এই ব্লগ পোস্টে আমরা বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্পের
বর্তমান অবস্থা, ভারতীয় প্রতিযোগিতার উৎস এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতা
বিশ্লেষণ করবো।
বাংলাদেশের টেক্সটাইল শিল্প: বর্তমান অবস্থা
উৎপাদন ক্ষমতা ও বৈশ্বিক অবদান
বাংলাদেশ
বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫.৭০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তৈরি পোশাকের মধ্যে জিন্স, টি-শার্ট, পোলোর মতো পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যাপক
চাহিদা সৃষ্টি করেছে।
কর্মসংস্থান
টেক্সটাইল
খাতে প্রায় ৪.৪ মিলিয়ন কর্মী নিয়োজিত, যার মধ্যে ৮০ শতাংশই নারী। এই খাত
বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কাঁচামাল আমদানি
বাংলাদেশের
টেক্সটাইল শিল্পের একটি বড় দুর্বলতা হলো, অধিকাংশ কাঁচামাল যেমন সুতা এবং কটন
আমদানি নির্ভর। এই নির্ভরতা উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ
সৃষ্টি করে।
ভারতীয় টেক্সটাইল শিল্প: একটি শক্তিশালী প্রতিযোগী
উন্নত কাঁচামাল সরবরাহ
ভারত
টেক্সটাইল উৎপাদনে কাঁচামালের স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম
কটন উৎপাদনকারী দেশগুলোর একটি। সুতা এবং কাপড় উৎপাদনের দিক থেকে ভারত বাংলাদেশকে
পিছিয়ে ফেলেছে।
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
ভারত
টেক্সটাইল খাতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেমন অটোমেশন এবং কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা। এই প্রযুক্তিগত অগ্রগতি উৎপাদন খরচ কমিয়ে প্রতিযোগিতামূলক দামে পণ্য
সরবরাহ করতে সহায়ক।
নীতিগত সহায়তা
ভারতীয়
সরকার স্থানীয় টেক্সটাইল শিল্পকে প্রণোদনা এবং ভর্তুকি দিয়ে সাহায্য করে।
"প্রোডাকশন লিংকড ইনসেন্টিভ স্কিম এই খাতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশের নীতিগত সহায়তার ঘাটতি তুলনামূলক বেশি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতা: মূল কারণ
১. কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীলতা
বাংলাদেশের
টেক্সটাইল শিল্পের অন্যতম দুর্বল দিক হলো কাঁচামাল আমদানি। তুলা, সুতা এবং রংয়ের
জন্য প্রধানত ভারত, চীন, এবং তুরস্কের ওপর নির্ভর করতে হয়। কাঁচামাল আমদানির খরচ
বৃদ্ধি উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে তোলে।
২. সীমিত প্রযুক্তিগত অগ্রগতি
বাংলাদেশের
অনেক কারখানা এখনো পুরোনো প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে
উৎপাদনশীলতা কম থাকে এবং মান নিয়ন্ত্রণেও সমস্যা দেখা দেয়।
৩. জ্বালানি খাতের সমস্যা
অবকাঠামো
দুর্বলতা এবং জ্বালানি সংকট উৎপাদন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। ভারত যেখানে
নিজের বিদ্যুৎ উৎপাদনে স্বনির্ভর, বাংলাদেশ সেখানে প্রায়শই লোডশেডিংয়ের সমস্যায়
ভোগে।
৪. সরকারি প্রণোদনার অভাব
সরকারি
সহায়তা যেমন ভর্তুকি, ট্যাক্স ছাড় এবং উদ্ভাবনী গবেষণায় বিনিয়োগ বাংলাদেশে
পর্যাপ্ত নয়। অন্যদিকে, ভারত এই খাতে ব্যাপক প্রণোদনা দিয়ে তাদের শিল্পকে টেকসই
করছে।
৫. শ্রমিকদের দক্ষতার ঘাটতি
যদিও
বাংলাদেশ শ্রমশক্তির দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিশালী, তবে দক্ষতার অভাব অনেক সময়
উৎপাদনশীলতায় বাধা সৃষ্টি করে। ভারত দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই ঘাটতি
কাটিয়ে উঠেছে।
প্রতিযোগিতার অর্থনৈতিক প্রভাব
ভারতীয়
টেক্সটাইল শিল্পের সঙ্গে প্রতিযোগিতার ফলে বাংলাদেশের শিল্পপতিরা বেশ কিছু সমস্যার
সম্মুখীন হচ্ছেন।
1.
মূল্য প্রতিযোগিতা: ভারত তাদের উৎপাদন খরচ কমিয়ে তুলনামূলকভাবে সস্তায় পণ্য
সরবরাহ করতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের পণ্যের দাম তুলনামূলক বেশি হওয়ায় রপ্তানি
বাজারে প্রতিযোগিতা কঠিন হয়ে পড়ছে।
2.
বাজার হারানো: ভারত বিভিন্ন মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং দ্বিপাক্ষিক চুক্তির
মাধ্যমে ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার বাজারে প্রবেশাধিকারের সুবিধা পাচ্ছে।
বাংলাদেশ এখনো এই ধরনের বাণিজ্য চুক্তিতে পিছিয়ে।
3.
উৎপাদন কমে
যাওয়া: কাঁচামাল আমদানির খরচ এবং
প্রতিযোগিতার কারণে অনেক ছোট এবং মাঝারি উদ্যোগ উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে।
টিকে থাকার কৌশল
বাংলাদেশ
যদি এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চায়, তবে কিছু দীর্ঘমেয়াদি এবং স্বল্পমেয়াদি
পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
১. স্থানীয় কাঁচামাল উৎপাদন
বাংলাদেশের
উচিত তুলা এবং সুতা উৎপাদনে স্থানীয় কৃষি ও শিল্পখাতকে উৎসাহিত করা।
২. প্রযুক্তির উন্নয়ন
অটোমেশন
এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৩. দক্ষতা উন্নয়ন
শ্রমিকদের
জন্য প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি চালু করা জরুরি।
৪. সরকারি নীতিগত সহায়তা
সরকারি
প্রণোদনা এবং রপ্তানি ভর্তুকি বৃদ্ধি করলে শিল্প খাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
৫. নতুন বাজার অনুসন্ধান
ইউরোপ
এবং আমেরিকার পাশাপাশি আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার নতুন বাজারগুলোতে প্রবেশ করার
কৌশল নিতে হবে।
বাংলাদেশের
টেক্সটাইল শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাত হলেও ভারতীয় প্রতিযোগিতার কারণে
এটি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অর্থনৈতিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হলে
প্রযুক্তিগত অগ্রগতি, কাঁচামালের স্থানীয় উৎপাদন, এবং সরকারি নীতিগত সহায়তার
প্রয়োজন। সঠিক পরিকল্পনা এবং কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশের টেক্সটাইল
শিল্প ভারতীয় প্রতিযোগিতার সঙ্গে সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবে এবং বিশ্ববাজারে
তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে সক্ষম হবে।
0 Comments