সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা বিনিময়: বাংলাদেশী পরিচয় গঠনে ভারতীয় মিডিয়ার ভূমিকা

 

সাংস্কৃতিক আধিপত্য বা বিনিময়: বাংলাদেশী পরিচয় গঠনে ভারতীয় মিডিয়ার ভূমিকা


বিশ্বায়নের এই যুগে সংস্কৃতি আর জাতীয় পরিচয় একটি দেশ বা জাতির জীবনের গভীরতম স্তরে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশ, তার স্বাধীন ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য গর্বিত একটি দেশ, তার পরিচয় গঠনে বহিরাগত প্রভাবের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ করেছে। ভারতীয় মিডিয়া, বিশেষত টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, এবং মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রেখেছে। এই প্রভাব কি সাংস্কৃতিক আধিপত্য, নাকি এটি একটি পরস্পর বিনিময়? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ভারতীয় মিডিয়ার ভূমিকা এবং তার ফলাফল নিয়ে বিশদভাবে আলোচনা করতে হবে।

ভারতীয় মিডিয়ার প্রসার

ভারতীয় মিডিয়া, বিশেষ করে বলিউড এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলি, দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর একটি বাজার দখল করেছে। স্যাটেলাইট টিভি এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে এই মাধ্যমগুলি বাংলাদেশে সহজলভ্য হয়েছে। স্টার প্লাস, জি বাংলা, কালারস বাংলা, এবং সনি এন্টারটেইনমেন্টের মতো জনপ্রিয় চ্যানেলগুলি বাংলাদেশে ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বলিউড চলচ্চিত্র এবং ভারতীয় মিউজিক ভিডিওগুলি তরুণ প্রজন্মের বিনোদন পছন্দকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করেছে।

বলিউডের প্রভাব

বলিউড, ভারতীয় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি, বিশ্বজুড়ে তার জনপ্রিয়তার জন্য পরিচিত। বাংলাদেশে বলিউডের গানের তালে নাচ, পোশাকের অনুকরণ এবং এমনকি কথোপকথনের ভঙ্গিমা প্রায়শই দেখা যায়। শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ বা মেকআপ স্টাইলে বলিউড তারকাদের অনুকরণ বিশেষ করে বিয়ের অনুষ্ঠানে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।

টেলিভিশন ধারাবাহিকের জনপ্রিয়তা

জি বাংলা বা স্টার প্লাসের মতো ভারতীয় চ্যানেলগুলোর ধারাবাহিক নাটক বাংলাদেশের ঘরে ঘরে জনপ্রিয়। "কিউকি সাস ভি কভি বহু থি" কিংবা "কৃষ্ণকলি"-এর মতো নাটকগুলো সমাজের পারিবারিক, নৈতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর প্রভাব ফেলেছে। অনেক ক্ষেত্রেই এই নাটকগুলো বাংলাদেশী সমাজের ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

সাংস্কৃতিক আধিপত্যের উদাহরণ

ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিভিন্ন রূপ দেখিয়েছে। এটি বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে দুর্বল করে তুলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ:

1.    ভাষার উপর প্রভাব: বাংলা ভাষার ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই হিন্দি শব্দে ভরে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে হিন্দি গানের প্রতি আসক্তি বাংলা গানের প্রতি উদাসীনতা তৈরি করছে।

2.    সংস্কৃতির আদান-প্রদান নাকি একমুখী প্রবাহ?: ভারতীয় মিডিয়া থেকে বাংলাদেশী দর্শকরা অনেক কিছু গ্রহণ করলেও, বাংলাদেশের সংস্কৃতি ভারতীয় সমাজে তেমন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এটি একটি একমুখী সাংস্কৃতিক আধিপত্যের উদাহরণ হতে পারে।

3.    পোশাক ও জীবনযাত্রার পরিবর্তন: ভারতীয় মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচারিত আধুনিক পোশাক এবং জীবনযাত্রার স্টাইল তরুণ প্রজন্মকে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং জীবনযাপন থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে।

সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগ

অন্যদিকে, ভারতীয় মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ কেবল সাংস্কৃতিক আধিপত্য নয়, বরং একটি নতুন সাংস্কৃতিক বিনিময়ও সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ:

1.    বিনোদনের উন্নয়ন: ভারতীয় সিনেমা ও টেলিভিশন নাটকগুলির প্রোডাকশন মান দেখে বাংলাদেশী নির্মাতারা নিজেদের কাজের মানোন্নয়নের চেষ্টা করছেন।

2.    সঙ্গীতের মেলবন্ধন: ভারতীয় সঙ্গীত শিল্পীরা বাংলাদেশী শিল্পীদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করছেন, যা নতুন সৃষ্টিশীলতা এবং মেলবন্ধনের উদাহরণ।

3.    প্রযুক্তিগত উন্নয়ন: ভারতীয় মিডিয়ার প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত হওয়ায় বাংলাদেশী মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলিও সেগুলি অনুসরণ করতে আগ্রহী।

বাংলাদেশের প্রতিরোধ এবং সজাগতা

বাংলাদেশ সরকার এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ভারতীয় মিডিয়ার সাংস্কৃতিক আধিপত্য ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলিকে আরও সমৃদ্ধ করার জন্য প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

1.    স্থানীয় চ্যানেলের উন্নয়ন: এনটিভি, আরটিভি, চ্যানেল আইয়ের মতো স্থানীয় টিভি চ্যানেলগুলি দর্শকদের আকর্ষণ করার জন্য নতুন নতুন অনুষ্ঠান তৈরি করছে।

2.    সংস্কৃতির প্রচার: বাংলাদেশী ঐতিহ্যবাহী নৃত্য, গান এবং নাটক আরও বেশি প্রচারিত হচ্ছে। পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি এবং বিজয় দিবসের মতো জাতীয় উৎসবগুলি ঘিরে অনুষ্ঠান বেশি প্রচার করা হচ্ছে।

3.    আইনি নিয়ন্ত্রণ: ভারতীয় চ্যানেলগুলির কন্টেন্টের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার দাবি উঠেছে। বিশেষত, ভারতীয় বিজ্ঞাপনের প্রচার নিয়ন্ত্রণে নেওয়া উদ্যোগগুলো উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশের পরিচয় গঠনে ভারতীয় মিডিয়ার ভূমিকা একটি জটিল বিষয়। এটি একদিকে সাংস্কৃতিক আধিপত্যের ঝুঁকি তৈরি করে, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সুযোগও এনে দেয়। তবে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকে সুরক্ষিত রাখতে হলে স্থানীয় সংস্কৃতি এবং মিডিয়ার উন্নয়নে আরও জোর দিতে হবে। ভারতীয় মিডিয়ার প্রভাবকে পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব নয়, তবে এটি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ নিশ্চিত করা সম্ভব।

 

Post a Comment

0 Comments